''সবুজ স্মৃতি'' পর্ব-৪

Picture Credit: Nuran Durdany

খুব বেশি যার কথা মনে পড়ে সে হল, নানু বাড়ীর উঠোন আর সন্ধ্যার আড্ডার বসায় জায়গাটা। রোদ-কাদা-বৃষ্টিজলে কতো দৌড়াদোড়ি উঠোন জুড়ে। নানুর ঘরের সামনে একটা বারান্দা আছে। বারান্দাটার চারপাশে জুড়ে বসার ব্যবস্থা তো আছেই সাথে পুরোটা ঘিরেই ভরপুর গাছগাছালি।  বারান্দায় বসে থাকলে ঐ দূরের পথ দেখা যায়, যে পথ দিয়ে সকলের আনাগোনা। যে পথ দিয়ে হেটে আমরা বাড়ীতে প্রবেশ করি।
বারান্দা টা হলো আড্ডার মূল মঞ্চ। বৃষ্টি শুরু হলে পাঁচ ঘরের সবাই মিলে বারান্দায় বসে থাকা আবার কেউ এসে আশ্রয় নেয় যাত্রাপথে। আর সন্ধ্যার পরপরই শুরু হয় পুরোন অন্ধকার রাতের আড্ডা। গ্রামের বাড়ীতে গেলে আশে-পাশে পরিচিত যতো পিচ্চি আর স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলে-মেয়ে আছে সবাই রাতে চলে আসতো আড্ডা দিতে। সবাই বসে বসে ভূতের গল্প থেকে শুরু করে- কার কি হালচাল অবস্থা ইত্যাদি ভূত ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আলাপন।

একটা ছোট্ট আড্ডার গল্প বলি। সন্ধ্যা থেকেই সবাই মিলে আড্ডা চলছে। আড্ডার বিষয় ছিলো কে ভূত দেখেছে, বাড়িতে কাকে জ্বীন ধরেছে ইত্যাদি। আমি যেহেতু ছোট ছিলাম তাই ভূত-টূত খুব ভয় পেতাম আর বারান্দায় আড্ডা দিলে কেউ হারিকেন নিয়ে বসে আড্ডা দেয় না। এই আড্ডার আসর একদম অন্ধকারেই। কেউ কারো মুখ দেখেতে পায় না। সবাই যার যার অবস্থানে বসে গল্পের ঝুড়ি থেকে গল্প বের করে বলতে থাকে। তো ভূতের গল্প যখন শুরু হলো আমি ভয়ে কাজ্বিনের পাশে গিয়ে বসলাম। ভূতের গল্পটা হচ্ছে এমন, 'পুরোনো বাড়ীতে এক ছেলে রাতে হেটে যাচ্ছে, রাত ১২ টার পরের ঘটনা। বাজার থেকে বাড়ী ফিরছে। তখন সে দেখলো কবর স্থানে সাদা একটা কাপড়। ছেলে টা দেখেই দাঁড়িয়ে গেলো, বাড়ির কাছে যেতে ভয় পাচ্ছিল, হঠাৎ ছেলেটার পাশেই যে লম্বা গাছ সেখানে উদ্ভট একটা শব্দ হলো। পাশে তাকিয়ে দেখে একজোড়া সবুজ চোখ জ্বল-জ্বল করে জ্বলছে...! সবাই খুব মনযোগ দিয়ে শুনছে। আরো বলতে লাগল; সাদা কাপড়ের কাকে জানি প্রতি রাতে অনেকেই দেখে। যার বিচরণ... কান্নার আওয়াজ!! কান্নার আওয়াজ!! জীবন্ত কান্নার আওয়াজ এবং ঘটন দু’টো শুনেই আমার আত্মা পুরাই শেষ। শুধু আমি কেনো সবার কানে আসছে চাপা কান্নার আওয়াজ... কে জানি চাপা কান্না করছে!! হঠাৎ সবার চোখ পড়লো ঝোপের দিকে, যেখানে মৃত মানুষদের গোসল করানো হয়। একটা সাদা কাপড় পরা কেউ বসে বসে কাঁদছে। চাঁদের আলো ঠিক সেই ঝোপে সাদা কাপড় বরাবর!

মুহূর্তেই ওরে বাবারে বলে বারান্দায় সবাই একসাথে চিৎকার। যারা দূরে দূরে বসে ছিলো মুহূর্তে এক জায়গায় জড়ো। সবার ভেতরে আতঙ্ক, কেউ কেউ সুরা পড়া শুরু করলো। কান্নার আওয়াজ বেড়েই চলছে। কাজ্বিন বলে উঠলো; আমাকে কেউ বরই গাছের ডাল ভেংগে এনে দে। গাছের ডালের খোঁজ করতে গিয়ে একটা লম্বা রডের খোঁজ মিলল। কাজ্বিন রড হাতে সবার সামনে আর পিছনে সবাই মিলে দোয়া পড়ছি উচ্চস্বরে। কাজ্বিন যতো এগিয়ে যাচ্ছে জোরে জোরে বলতে শুরু করলো ‘এই রড দিয়ে বাড়ী মারলে ভূত কেন জ্বীনের বাপ এসে বাপ বাপ করবে’। কাজ্বিনের সাথে আরও একজন ততোক্ষণে মারতে এগিয়ে গেলো। যখনই ঐ আলোকে রড দিয়ে মারতে যাবে ওমনি কাজ্বিনের নাম ধরে চিৎকার দিতে থাকলো সাদা কাপড়ের পেত্নী!!

একটু পর আমরা হেসে গড়াগড়ি আর বকা দিলাম তাকে? সেই পেত্নীটাকে! ঘটনা যেটা হলো, আমরা যখন ভূতের গল্পে গভীরে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম তখনই গল্পের আসর থেকে এক খালামনি সরে গিয়ে তার বাবার সাদা পাঞ্জাবী পড়ে আসে আর বাঁশ ঝোপে গিয়ে কান্না শুরু করে এবং ভয় দেখানোর দিক থেকে সে পুরোপুরি ভাবেই স্বার্থক!
আহা, সবুজ স্মৃতি...  সেই দিন গুলোর কথা মনে পড়লে হাসি পায় আবার খারাপও লাগে। এখন যদি আগের দিনে ফিরে যেতে পারতাম। ওটাতো একদমই সম্ভব না। আসলেই সময়ের স্রোতে সব কিছু বদলে যায় পরিবেশ-পরিস্থিতি-সম্পর্ক...



মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ