''সবুজ স্মৃতি'' পর্ব-৭

Picture Credit: Nuran Durdany

গ্রামের সবুজ স্মৃতিগুলোর মাঝে কখনো কখনো কালো স্মৃতিগুলোও ধরা দেয়। তার মধ্যে একটা-দুটো স্মৃতির কথা বলা যাক, যেগুলো কে মনে করতে চাই না কিন্তু প্রায়ই সেই স্মৃতিগুলো কে বেশী মনেকরি। ঘটনা গুলো ছিলো এমন;

একবার দাদুর বাড়ীতে ঈদের পরেরদিন যাচ্ছি। প্রচুর ভীড়, বাসে কোন সিডিউল দেওয়া যাচ্ছে না, সিট নেই। সকাল ৫টায় বাস কাউন্টারে গেলাম কিন্তু সকাল ৮টায় বাস ধরতে পারলাম। তাও আবার শেষের দিকে সিট, খুব বাজে অবস্থা। যাচ্ছি তো যাচ্ছি ঝাঁকি খেতে খেতে। একটু পর হঠাৎ ঝগড়া শুরু হলো বাসের মধ্যে। একজন যাত্রী আরেকজন যাত্রী কে গরু-মহিষ বলে গালি দিচ্ছে, ব্যাপার টা খুবই হাস্যকর ছিলো, কিন্তু বিরক্তিকর! কি নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল মনে নেই। আমরা কুরবানী ঈদের পরদিন গ্রামে যাচ্ছিলাম। তাই হয়তো একজন আরেকজন কে গরু-মহিষ টাইপ গালাগালি করছিল! কিন্তু একটু পর সব গালিগালাজ থেমে গেলো, একটা দৃশ্য দেখে। মানুষের জীবনে কখন কি হয়ে যাবে কেউ বলতে পারে না, ঠিক তেমনি সবাই বলতে পারে না একটু পর তার চোখ দিয়ে সে কি দেখতে যাচ্ছে। তখন আমরা কাঁচপুর পেরিয়ে মেঘনা ব্রীজ না কি অন্য কোন ব্রীজের উপর ছিলাম মনে নেই। একটা রোড এক্সিডেন্ট!! একটা মানুষ রাস্তায় পড়ে আছে মাথা এক দিকে, তার ব্রেইন একদিকে, দেহটা একদিকে!!! ব্রীজের উপর এক্সিডেন্ট টা হয়েছে, তাই কেউ যে লাশ টা সরাবে সেই উপায়ও নেই। আর ব্রীজের উপর দিয়ে গাড়ী ছাড়া কোন মানুষ হেঁটে যায় না। মাঝখানেই একটা বাস, সেটার অর্ধেক পাশ ধুমড়ে-মুছড়ে গেছে। আমি মানুষটা কে দেখেই চোখ সরিয়ে ফেলি ঠিকি, কিন্তু আজও সেই দৃশ্য চোখে ভেসে ওঠে।

আরেক দিনের ঘটনা;
চাচী আর আমি চাঁদপুর টাউনের ব্ল্যাকদাদুর বাড়ি যাচ্ছি। সকাল-দুপুর-রাত যখন ইচ্ছে আমরা চলে যাই ঘুরতে ব্ল্যাকদাদুর বাসায়। আমি-চাচী রিক্সায় বসে হাওয়া খেতে খেতে যাচ্ছি। একটু পরেই বাতাসে একটা গন্ধ নাকে আসলো। খুব বিশ্রী গন্ধ। চাচী হঠাৎ আমার নাম বলেই জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলো। আমি বললাম কি হয়েছে চাচী? চাচী বলে উঠলো; সামনের রিক্সায় কি জানো? আমি সামনের রিক্সায় তাকালাম দেখলাম একটা লোক বসে সিগারেট টানছে, নিচে একটা বড় কি জানি। ঠিক সেই ভাবে খেয়াল করতেও পারছিলাম না। ওই রিক্সাকে ওভারটেক করতে গিয়েও বিশ্রী গন্ধটা আরো বেশি নাকে আসছিল। কিন্তু রিক্সাটা কে ওভার টেক করা গেলো না। চাচীর কাছে জানতে চাইলাম; ওটা কি?
চাচী বলতে লাগলো তোমাকে বলতে চাচ্ছি না, তুমি ভয় পাবা। কিন্তু চাচীর নিজেই ভয় পেয়ে গেছে। তাই আমাকে বলে দিলো। চাচী বলতে লাগল; রিক্সার মধ্যে একটা লাশ। লাশটা কে মর্গে নেওয়া হচ্ছে। আমি শুনে পুরাই '', এইসব কি বলে ! পরে দেখলাম আসলেই তাই! লাশটা কে মোটা নীল রঙের একটা পলিথিনে পেঁচিয়ে তার উপর চট দেওয়া হয়েছে। ওই মৃত মানুষের পা এর আঙ্গল গুলো চাচী দেখতে পেয়ে চিৎকার দিয়ে উঠে। আমি হাত দিয়ে মুখ ডেকে ফেলি। চাচী বলতে লাগল; মনে হয় আত্মহত্যা করেছে, কয়েকদিন পর লাশটাকে পেয়েছে তা না হলে এমন গন্ধ হওয়ার কথা না। লাশ পেয়েই এখন মনে হয় মর্গে নেওয়া হচ্ছে। দেখো দড়ি দেখা যাচ্ছে। আঙ্গলের উপরে মাছি, পায়ের নখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ওটা একটা ছেলে!  


আমাদের রিক্সাটা কোন ভাবেই সামনের লাশের রিক্সাটা কে ওভার টেক করতে পারছে না। আমাদের রিক্সাওয়ালা নাক ধরে রিক্সা চালাতে লাগল আর লাশবহনকারী রিক্সাওয়ালাকে বলল; আমাদের আগে যেতে দিতে। একটু স্লো করলো রিক্সা টা, আমরা দ্রুত চলে গেলাম। আমি খুব অবাক হয়েছি এই দৃশ্য দেখে, লাশের উপর একটা মানুষ বসে বসে সিগারেট টানছে কি করে? ভিতরে কোন ভয় জাগে না? কি অদ্ভূত জগত! এখন অবশ্য বুঝি সিগারেট খাওয়া সেই লোকটার ওভাবে বসে ধোঁয়া উড়ানোর কারন। সেইদিন রাতে ঘুমাতে পারিনি। বার বার মনে পড়ছিলো আর সেই বিশ্রী গন্ধটা ভেসে আসছিলো। অনেক ভুলতে চেস্টা করেছি কিন্তু পারিনি। একজন মানুষ মারা গেলে তার শরীর পচে কি পরিমাণ দুর্গন্ধ বের হয় সেই দিন বুঝতে পেরেছি। তবে এখনো আমি নীল পলিথিন আর চট দিয়ে জড়ানো, সেই মৃত মানুষটার গন্ধ পাই!

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ