পু-ন-ম
Picture Credit: Nuran Durdany |
পুনম কে খুঁজতে যাচ্ছি। দু’দিন আগে রৌদ্দুর সকালে তার সাথে শেষ কথা হয়। শুধু একটা কথা জানতে সে আমাকে ফোন করে। কথাটা খুব সাধারন কিন্তু অনেক পবিত্র। কি মনে করে আমি তখন উওর দেইনি এখনো বুঝতে উঠতে পারিনি। আসলে সহজ কথা, যায় না বলা সহজে। যদিও সে শর্ত দিয়েছিল প্রশ্নের কোন উওর না পেলে সে হারিয়ে যাবে। কিন্তু জানি পুনম কখনো হারাবে না। পুনমের পাগলামীটা আমার কাছে মাঝেমধ্যে মাত্রা অতিরিক্ত মনে হয়। তাই প্রায়ই আমি বিরক্ত হয়ে যাই আর ঝগড়া করি। কিন্তু একটু পর কিভাবে জানি পুনম সব ঠিক করে ফেলে। তবে গত দুইদিন ধরে সেল ফোনটা বন্ধ করে রেখেছে এবং একটা ছোট মেসেজ পাঠিয়ে জানিয়ে দিয়েছে এবার ঠিকি যাবে! তার মেসেজটা পড়ে হাসি এলো। কিন্তু কেন জানি পরমুহূর্তে তার জন্য অস্থিরতা কাজ করে। জানি পুনম শহর ছেড়ে নির্জন সমুদ্রে কাছে গিয়েছে, আর কোথায় গিয়েছে তাও জানা আছে খুব ভালো ভাবে। তাই তাকে ফিরিয়ে আনতে সেখানে যাচ্ছি।
একটা কালো আলোতে সাদা
ক্যানভাস, পুনম সেই
ক্যানভাসে ছবি আঁকছে। দারুন ছবি আঁকে। পুনম দাঁড়িয়ে ছবি আঁকছে। কিন্তু কিসের ছবি আঁকছে দূর থেকে বুঝতে পারছি না। পুনমকে
সারপ্রাইজ দিবো তাই একটু দূরে দাঁড়িয়ে! হঠাৎ পুনম পিছনে ফিরলো।
আমার দিকে তাকিয়ে স্থির দৃষ্টিতে মুচকি হাসতে লাগলো। আমি ও পুনমের দিকে তাকিয়ে
রইলাম। তাকে আজ অদ্ভূত সুন্দর লাগছে। সব সময় তার চুল গুলো এলোমেলো থাকতো কিন্তু আজ চুল গুলো পরিপাটি। সাদা
একটা পাঞ্জাবী পরেছে। আমার দিকে সে তাকিয়ে হাসছে, আমিও তার দিকে তাকিয়ে। এ যেনো
অন্যরকম একদৃষ্টি, তার তাকিয়ে থাকা চোখের ভাষা কি বলতে
চাচ্ছে স্পষ্ট নয়!
সূর্যাস্ত সময়, পুনম চোখ
সরিয়ে সমুদ্রের দিকে ধীর গতিতে হেঁটে চলছে। আমি তাকে ডাক দিলাম। পুনম হেঁটে যাচ্ছে, আমি ডাকছি… পুনম একবারও পিছনে তাকাচ্ছে না। আমি চুপ করে গেলাম, পুনমকে
দেখছি। কিন্তু তাকে ডাক দেওয়ার কোন শক্তি পাচ্ছি না। পুনম সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে
সমুদ্রের ঢেউ গুলোর দিকে এগিয়ে যেতে লাগল! আমি হেঁটে পুনমের ক্যানভাসের কাছে গেলাম। কাছে গিয়ে দেখি ওখানে কিছু আঁকা নেই! অথচ ওখানে দু’টো সূর্যমূখী জন্ম হবার কথা, যেটা সে রোজ স্বপ্নে
দেখে। ফাঁকা ক্যানভাস থেকে চোখ সরিয়ে পুনমের দিকে তাকালাম। কিন্তু পুনম তো নেই!
সাগরের বড় বড় ঢেউ ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এই দৃশ্য দেখে কেনো
জেনো মাথা টা চক্কর দিল। দৌড় দিয়ে চেষ্টা করলাম পুনম কে খুঁজতে সূর্যাস্ত বালিরেখা ধরে।
কিন্তু কি আশ্চর্য! দৌড়াতে দৌড়াতে আমি হাপিয়ে যাচ্ছি কিন্তু কোথায় যেতে পারছি না! চারপাশের দিকে তাকালাম জনমানব শূন্যহীন হাহাকার, অন্ধকার
নেমে আসছে সাথে সাথে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। একটু থামতেই বালুতে পড়ে গেলাম, মনে হচ্ছে তলিয়ে যাচ্ছি... বালুর গভীরে... আরও গভীরে... নিজের সর্বশক্তি দিয়ে একটা কথাই বলতে চেষ্টা করলাম 'সত্যি আমি এসেছি পু-ন-ম, ভালোবাসি ভালোবাসি'!
পরিশিষ্ট
রুম B-35 থেকে প্রতি রাতে তমার
কান্না কন্ঠে ভেসে আসে এই কথা গুলো বিড়বিড় করে। তমার প্রথম দিককার কথাগুলো ঠিকই
আছে, পুনম কে খুঁজতে সে সমুদ্রের দিকেই যাচ্ছে। কিন্তু শেষ
পর্যন্ত সেখানে পৌঁছাতে পারেনি। সেইদিন তমা রোড এক্সিডেন্টের মুখোমুখি হয় এবং
স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলে। তমা অসুস্থ হওয়ার পর পুনমকে হাজির করানো হলেও, তাকেকে চিনতে পারেনি। তমার পরিবার-পুনম সবাই চেষ্টা করে গেছে তাকে সুস্থ
করার জন্য। এক এক করে তমার পছন্দের সবকিছু পুনম হাজির করেছিলো । গত ৪বছর ধরে তমার পরিবারের একমাত্র মা ছাড়া আর কেউ তমাকে দেখতে আসে না!
পুনমও আর কোন খোঁজ রাখেনি। আর তমা?
প্রথম থেকেই তার কেসটা কেউ ধরতে পারচ্ছে
না। সব রিপোর্ট ঠিক আছে। অথচ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আনার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ
হয়েগেছে। কোন সমাধান আর খুঁজে পাওয়া যায়নি, কি হতে পারে কারো জানা নেই। তাই হাসপাতলই তার একমাত্র ঠিকানা। মানসিক
হাসপাতালে তমার রোজকার রুটিন সারাদিন হাসপাতালের মাঠে দাঁড়িয়ে খেলনা
মোবাইল নিয়ে খেলা করা আর রাত নেমে এলে দেয়ালে নিজের ছায়ার দিকে তাকিয়ে থাকা। তারপর
বিড়বিড় করে শুরু করে তার কাল্পনিক ঘটনাটা। প্রতিদিন রাতে একবার করে বলে আর গল্পটা
বলা শেষ হলে ঘুমিয়ে পড়ে। হাসপাতালের সবাই তার বিড় বিড় কথা গুলো স্পষ্ট শুনতে না
পেলেও শেষ কথাটা ঠিকই শুনতে পায়। প্রতি রাতে তমা তার সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠে 'সত্যি আমি এসেছি পু-ন-ম, ভালোবাসি ভালোবাসি!'
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন