আবেগ-৩০/এ!
Picture Credit: Nuran Durdany |
কি আছে জীবনে!
ভাবনা নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যথা নেই। আমার মাথা ব্যথা নেই জীবন অথবা জীবনবোধ নিয়ে। জীবনে কিছু নেই এই বুঝেই যা ইচ্ছে তাই করে ফেলা যায়। অনেক স্বপ্ন দেখা যায় জেগে থেকে অথবা ঘুমের ঘোরে। আসলে আমি শব্দে শব্দে খেলি। কিন্তু আমার অজান্তে কি ঘটে যায় তার হিসেব রাখিনি। এই কিছুদিন আগের কথা আমার আবেগ শব্দটার সাথে প্রথম পরিচয় হয়!
শনিবার অফিসে ছুটি। দুপুরে ঘুম থেকে উঠে ছাত্রী পড়াতে যাই। বিকেলে মাঠে ফুটবল খেলার প্রস্তুতিটা নিয়ে বের হলাম। সপ্তাহে দু’দিন পড়াতে আসি, ছাত্রীকে তার পড়াটা রিভিশন করতে দিলাম। বসে বসে চিন্তা করছিলাম আজকের ছাত্রীর মা বিকালে কী নাস্তা দিবে! এতো দারুণ সব খাবার বানায়। আহ্ কী বলবো! ভীষণ ভালো মানুষ তারা। আমাকে বেশ পছন্দ করে। তাই সপ্তাহে দুই দিন পড়ালেও তাদের কোন আপত্তি নেই তাতে। হঠাৎ চিন্তার মধ্যে একটা শব্দ ঢুকে পড়লো। ক্লাস টু’এর বাচ্চা মেয়েটা জিজ্ঞেস করে বসে, আচ্ছা স্যার আবেগ অর্থ কি? শব্দটা শুনেই কানের মধ্যে একটা ঝাঁকুনি খেলো। কেমন জানি থতমত খেয়ে যাই। ক্লাস টু’এর বাচ্চামেয়ে, আমার কাছে জানতে চায় আবেগ শব্দের অর্থ! আবেগ কী জিনিস রে বাবা! আবেগ! এর খোঁজ করতে থাকি মনে মনে। একটু পর গরগর করে মুখ দিয়ে বলে ফেলি মায়া-ভালোবাসা-কান্না-হাসি! তারপর আর বাচ্চা মেয়েটা কোন প্রশ্ন করে না। মনটা কেমন জানি হয়ে যায় মুহূর্তেই। আমারও জিজ্ঞাস করতে ইচ্ছে করছে না আবেগ শব্দের অর্থ কেন জানতে চাইল । আজ আর পড়াবো না, বলেই উঠে আসি।
পশ্চিম ক্লাবের ফুটবল দল আজকে খেলায় জিতে গেছে। সৌরভ মাঠের এক কোণে বসে।
বাচ্চা মেয়ের মিষ্টি কন্ঠের আবেগ শব্দটা এখনও তার কানে লেগে আছে। ভাবনা জুড়িয়েই
উদাসীন চিনচিনে মাথা ব্যথা। ফুটবল খেলা শেষ করে সবাই ঘাসের উপর গড়াগড়ি খাচ্ছে। উদাস
দৃষ্টিতে সৌরভ দেখে নিচ্ছে সন্ধ্যার দৃশ্যপট, ঘাসের উপর বসে ঘামে ভিজে যাচ্ছে কেউ
কেউ আর মাঠের কোণে বাচ্চাদের দৌড়াদৌড়ি । মেঘ কেমন দ্রুত বাড়ি ফিরছে। শহরটা
পানির উপর ভাসছে। চোখ ঝাঁপসা হয়ে আসে তার ছদ্মছায়ায়...
নিউমার্কেটের ভীড়ের মধ্যে একটা হলুদ রঙের ওড়না কাঁধব্যাগের চেইনে আটকে যায়।
দুইজন দুই মেরুতে যাওয়ার মধ্যবর্তী দূরত্বে টান লাগলেই , চোখে চোখে বিরক্তির
খেলা। কেউ কাউকে দুঃখিত বলার সুযোগ খুঁজিনি বরং হেঁটে চলে গিয়েছি। আরেকও একবার
বইমেলায়, বইয়ের স্টলে খুব ব্যস্ততার ছলে বই খুঁজতে আবারও দেখা। আমি তাকিয়েই রইলাম,
কিছু বলার শব্দ খুঁজে পেলাম না। দেখলাম বন্ধুদের সাথে হাসতে হাসতে কিটি
পুতুলের ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে ভিড়ের মধ্যে মিশে যাচ্ছে। না কোন প্রেম-ভালোবাসা
জাগেনি। নানান মুখের মতো সেই মুখ কোন অনুভূতি নেই। তারপর অনেক মাস পর, পড়াশোনা
শেষ করে বেকারের খাতা থেকে নিজের নামটা কাটার উদ্দেশ্যে রিক্সায় বসে যাচ্ছিলাম
অফিসে। হঠাৎ দেখি ৩০/এ বাসার বারান্দার রেলিং ধরে সেই মুখ উঁকি দিয়ে আছে। একটু
অবাক লাগে এইবার। কিভাবে সম্ভব, এভাবে একজন এর মুখ বার বার খুঁজে পাওয়ার! এভাবে প্রতিদিন দেখি তাকে। নিজের মনে ভালো লাগা
সুড়সুড়ি দেয়। তাকিয়ে দেখা হয়, এই যা। একদিন সাহস করে
চোখের ইশারা দেই। মুচকি হেঁসে দাঁড়িয়ে থাকে। কেন জানি মনে হল, চিনেছে আমাকে। এভাবেই চলে যাওয়া, ভালো লাগার দিন।
তবে সেই ভালো লাগার ভেতর একটা অদ্ভুত ঘটনা রয়েছে। কিছুদিন এভাবেই যাচ্ছি-দেখচ্ছি সময়ের
এক সন্ধিক্ষণে এসে আমার আবিষ্কার করতে বাকি থাকেনি!!
কোথাও একটা ভুল হয়েছে আমার। কিন্তু মন যেটা বলছে সেটা মিথ্যে হোক তাইতো আমার
চাওয়া। আমি আবিষ্কার করি সেই হলুদ ওড়না, কিটি পুতুলের ব্যাগ কাঁধের মেয়েটা যে তার
বন্ধুদের সাথে হাসছিলো, সেই হাস্যময়ী মেয়েটার জীবনের পা দু'টো। ওখানে সেটা নেই! এমন কেনো
হলো? কিভাবে হলো? আসলেই তাই? আবেগে পড়ে যাই আমি। মায়া কিংবা ভালোবাসা নয়, আমার
অনুভূতিরা আজ চোখে ভিজিয়ে তুলছে। নিজেকে বার বার বুঝিয়েছি আমার কোথাও ভুল হয়েছে।
এতো খারাপ লাগছে কেনো তবে! আমি মন খারাপ করি না, আমি ভাবিও
না। আমার মাথা ব্যথা নেই তাতে। কিন্তু আজকের সন্ধ্যায় মনে হচ্ছে বার বার, একটা লাল ওড়না জড়িয়ে সেই মানুষ হেঁটে আসুক এই মাঠে। একসাথে দু'জন হাত ধরে হাঁটি। বাতাসে তার ওড়না উড়তেই, আমাকে
স্পর্শ করুক। সে তার দু'পা দিয়ে হাঁটুক। চোখের দিকে তাকিয়ে
বিরক্তি প্রকাশ করুক। তার কালি পড়ে যাওয়া চোখে যে কাজল ম্লান হয়ে গেছে, সেখানে নতুন করে কাজল আঁকা থাকুক। কেমন জানি অস্থির লাগছে। যেদিন ওর অবস্থাটা
আবিষ্কার করি সেইদিনের পর থেকে আর ৩০/এ বাসার বারান্দায় তাকাই না। অন্য রাস্তা
দিয়ে অফিস পাড়ায় আসি। হয়তো সে প্রতিদিনের মতো রোজ বারান্দার রেলিং ধরে উঁকি
দিয়ে থাকে। হয়তো তার খুব হাঁটতে ইচ্ছে করে, হয়তো ঘুরতে ইচ্ছে করে। সে কি আমাকে
খোঁজে! নাহ, থাকুক সে। কেন মিছে মিছে আবেগে ভাসছি। কি আছে জীবনে..
সন্ধ্যা নামছে...
সন্ধ্যা নামছে...
সৌরভের পায়ের কাছে ফুটবলটা পড়ে ছিলো। সৌরভ বসা থেকে দাঁড়িয়ে উঠে খুব জোরে
বলের গায়ে লাথি দিল। বলটা দূরে গিয়ে পড়ল। সৌরভ দেখল সূর্যাস্ত পেরিয়ে রক্তিম
হয়ে উঠেছে আকাশ, একটা বারান্দায় বাতাসে উড়ছে একটা টকটকে লাল ওড়না...
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন