''সবুজ স্মৃতি'' পর্ব-৫

Picture Credit: Nuran Durdany

রেললাইনের মাঝ বরাবর একা হাঁটছি, একটু পর বাড়ী ফিরে যাবো। সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে কাউকে না বলেই জমির উপর দিয়ে হেটে একা চলে এসেছি রেললাইনে হাটতে! একটা সময় ছিলো আমি আর ফুপ্পি গ্রামের এলেই রোজ রেল-লাইন সরলরেখায় দু-জন দু-জনের হাত ধরে হাঁটতাম। অনেক দূর পর্যন্ত গিয়ে আবার ফেরা.. ছোট ফুপ্পির মতো আমারও উড়ুউড়ু। আমার কেন জানি মনে হয় পরিবারের ছোট সন্তানরা এমন উড়ুউড়ু ঘুরুঘুরু হয়!

ফুপ্পি আর আমি হাটতাম চলে যেতাম গুচ্ছ গ্রামে। সেখানে গিয়ে ফুপ্পি অচেনা মানুষের সাথে কথা বলতো, কি করে তারা জীবিকা জোগাড় করছে, কিভাবে তারা থাকে ইত্যাদি জানতে চাইতো। গুচ্ছগ্রামের ঘর গুলো নদী ভাংগনে সর্বস্বহারা মানুষের জন্য সরকার তৈরি করে দিয়েছে। ভালোই লাগতো, বালুচরের গুচ্ছগ্রামে নতুন টিনসেডের ছোট ছোট ঘর। তো সেই সময়ই ডাকাতিয়া নদীর উপর একটা ব্রীজ করছে, তখন ফুপ্পি আমাকে নিয়ে যেতো ব্রীজ দেখাতে। ফুপ্পি আমাকে পেলেই হতো ঘুরাঘুরি শুরু, সারাদিন চিন্তা করতো কোথায় কোথায় যাওয়া যায়! গ্রামে আসলে ফুপ্পি যেখানে নিয়ে যেতো, আমিও সেখানেই যেতাম। তো ব্রীজে যাওয়া নিয়ে একটা বড় রকমের ঘটনা আছে। সেটা হল; ডাকাতিয়া নদীর উপর যে ব্রীজ টা তৈরি হচ্ছিল তার চারপাশে শুধুই পানি ছিল, আর পানি থাকবে এটাই স্বাভাবিক? ব্রীজের কাছে যাওয়ার দু’টো রাস্তা ছিলো। একটা গুচ্ছ গ্রামের ভিতর দিয়ে আরেকটা পানি দিয়ে!

ব্রীজ করার সুবাদেই ডাকাতিয়া নদীর পানিতে বালি ফেলা হলো, রাস্তার মতো তৈরি করা হলো। আমরা ব্রীজে গেলাম গুচ্ছ গ্রামের ভেতর দিয়ে। কিন্তু ফেরার পথে বালি ফেলা পানির রাস্তা দিয়ে! তখন বর্ষা কাল ছিলো তাই প্রচুর পানি ছিলো, ডাকাতিয়া নদী বোঝাই যাচ্ছে নদীর পানির উচ্চতা। তো আমি-ফুপ্পি আর বড় ভাইয়া বাড়ী ফিরছি। আমি তো অনেক ছোট পানির নিচে বালু দেখেই হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল, বার বার পা আটকে যাচ্ছিল। ফুপ্পি বড় ভাইয়াকে বলল সামনে থাকতে আর সাবধানে হাঁটতে। আমি ফুপ্পির সাথে সাথে হাটছি কিন্তু পিছিয়ে পড়ছি। হঠ্যাৎ করে বালুর মধ্যে আমার পা আটকে গেলো এবং কিছুতেই পা কে তুলতে পারছি না! ফুপ্পি তো হেঁটে হেঁটে সামনে চলে যাচ্ছে। এদিকে আমার মনে হলো ভেতর টানছে, পড়ে যাচ্ছি! বড় ভাইয়া সামনে, ফুপ্পিও সামনে। তাদের কে ডাকার মতো কোন শক্তি নেই পানির ভেতর তলিয়ে যেতে থাকি। নাক-মুখ দিয়ে পানি গিলছি। কানে শুধু একটা চিৎকার শুনলাম, আমি হাবু ডুবু খাচ্ছি! হুট করে চিল যেমন মাছ ছোবল দেয় পানির নিচ থেকে ফুপ্পিও আমাকে টেনে কোলে তুলে নেয়। সেই কি কান্না শুরু। অনেক ভয় পেয়েছিলাম। ফুপ্পি বার বার মাথায় হাত বুলাতে থাকে আর বলতে থাকে ,তুমি আমার সাথে ছিলে ওখানে গেলে কি করে? আজ কিছু হলে কি যে হতো? তোমাকে খুঁজে পাওয়া যেতো না। ভাই-ভাবী যে কি বলতো? সবাই আমাকে.......! আল্লাহ মাফ করুক!
ফুপ্পিও ভয়ে আতঙ্কিত! কিছু হয়নি, কিছু হয়নি বলে আমাকে সান্ত্বনা দিতে লাগল। ফুপ্পি আর ভাইয়ার কথা কানে আসছিল। ভাইয়া ফুপ্পি কে বলতে লাগল; ‘আর কোন দিন ব্রীজ আসবো না আর আসলেও এই রাস্তা দিয়ে আসবো না। আজ ও যদি নদীতে তলিয়ে যেতো, আমরা যদি উঠাতে না পারতাম। যদি মারা যেতো তাহলে কি হতো?’ এই কথা বলে ভাইয়া কান্নায় ভেংগে পড়ে। ফুপ্পি বলে বসলো আমারি শিক্ষা হলো, ওকে হাতে ধরে রাখাটা উচিত ছিলো। আমি কি বুজেছিরে এমন কিছু হবে। তারা দু’জন পরামর্শ করলো এই ঘটনা কাউকে জানানো যাবে না এবং  আমাকে ফুপ্পি বলল কাউকে কিছু না বলতে! বাড়ি ফিরেই আমার হাতে পায়ে গরম তেল মালিশ করে ফুপ্পি আমাকে ঘুম পারিয়ে দেয়।'

রেললাইনে হাঁটতে গিয়ে চোখ পড়ে গেলো ব্রীজের দিকে, একবার ভাবলাম ওখানে যাই। কিন্তু গেলাম না! একটু পর ব্যস্ততা বাড়বে চারপাশে, রোদ উঠেছে। এখানে বাতাস বইছে, আমাকে বাতাস ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে। বাতাসের  স্রোতে গাছের পাতার শব্দ হচ্ছে, খুব সুন্দর চারপাশে। আর সামনে হাঁটলাম না এবার বাড়ী ফেরার উদ্দ্যেশে হাঁটতে শুরু করলাম। জমির উপর দিয়ে না গিয়ে, ধুলোমাখা পথে হাঁটছি। আমি সব-সময় এমনি করি। বিশেষ করে গ্রামে এলেই। যে পথ দিয়ে হেটে যাই পরের বার অন্য পথ দিয়ে ফিরে আসি। বাড়িতে প্রবেশ করতেই চাচীকে দেখলাম রান্না ঘরে কাজ করছে। আমার দিকে তাকিয়ে হাসি দিয়ে বলল; কোথায় গিয়েছিলে? আমার মুখ থেকে কোন শব্দ বের হলো না। চাচী বলল একটু পর নাস্তা তৈরি করবো, এখন তুমি কি খাবে, মুড়ি দিবো? ওটা খাবে নাকি পিঠা বানিয়ে দিবো?
এবার আমি মৃদু হাসলাম কথা বললাম; কিছু করা লাগবে না, আপনি কাজ করেন। চাচী আচ্ছা শব্দ বলে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। দাদুবাড়িতে উনি একজন মানুষ, যে সবার খেয়াল করেন। সবকিছুর ব্যবস্থা করেন। আর কেউ গেলে অস্থির হয়ে যায়, কি খাওয়াবে না খাওয়াবে। আমার সব চাচীরা ঢাকায় থাকে, কেউ আবার বিদেশে! একমাত্র ছোট চাচী গ্রামে থাকেন দাদা-দাদীর দেখা শোনা করেন। ঘরে এসেই আমি সোজা ছাদে চলে গেলাম, একটা শীতলপাটি বিছিয়ে ছায়াতে বসলাম। একটু পর একটা ট্রেন গেলো, চোখ চলে গেলো সেখানে!


ভেতরে ভেতরে মনে বলে বসলো আমাদের জীবন টা ট্রেনের মতো, ট্রেন যেমন ছুটে চলছে জীবন ও.... প্রতিটা ট্রেন একটি নিদিষ্ট স্টেশনে গিয়ে থেমে যায় আর জীবন ট্রেন!! ওটা যে কোথায় গিয়ে থেমে যাবে কেউ জানে না। কিন্তু একটা স্টেশনে আমাদের সবাইকে যেতেই হবে একদিন আর সেই স্টেশনের নাম 'জাগ্রতিক ছুটি'!

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ