ভালোবাসার কালো থাবা!
Picture Credit: Nuran Durdany |
কোন এক পিচ্ছিল বস্তুর ভিতর থেকে বের হয়ে আসলাম, কতটুকু কষ্ট হচ্ছিল তা বুঝে ওটার আগেই চোখের মধ্যে একটা উজ্জ্বল কিছু এসে পড়লো। একটুপর চোখ খুলে দেখি সবাই দাঁত বের করে হাসছে। সবাই খুব খুশি! টের পেলাম আমি কারো পাশেই আছি। যে আমাকে আগলে রাখছে ,পরিচিত ঘ্রান। ওই হাসী মুখের মানুষগুলোর থেকে আমি যার পাশে আছি তার কাছেই বেশি নিরাপদ। প্রতিদিন একটু করে বেড়ে উঠছি। কেউ বকা দিলে বুঝতে পারছি বকা দিচ্ছে, কেউ আদর করলে বুঝতে পারছি আদর করছে। একটু একটু করে যত্ন বাড়ছে সাথে আমিও!
বাবা কে ছোট সময় খুব একটা
কাছে পাইনি। মা আর আমি ঢাকায় থাকি তখন। মা কে একদিন বললাম বাবা কোথায়, মা বলল আছে, কেন? আবার বললাম; বাবা আসেনা কেনো? মা বলল; তোর বাবা
বিদেশে গেছে। মা সব সময় তুই করেই ডাকতো আমাকে! এভাবে প্রায়ই প্রশ্ন করলে মা একই কথা বলতেন, একদিন বাবা কে ভুলে গেলাম। মা কেও জিজ্ঞাস করিনি আর বাবা
কোথায়! বন্ধু-বান্ধব পড়াশুনা এভাবেই দিন যাচ্ছে। হঠাৎ করেই আমার মায়ের ব্যবহার
বদলে গেল, আমাকে সব সময় ধমক আর অভিযোগের উপর রাখতো। আমাদের বাসায়
তেমন কেউ আসতো না শুধু একজন মামা ছাড়া। মামার সাথে খুব ভাব ছিল আমার।একদিন মামা কে
বললাম আম্মুর ব্যবহারের কথা, কয়েকদিন ধরে কেনো এমন করছে? এই কথা বলেই ভ্যা করে
কান্না করে দিলাম। মামা বলল; আম্মুতো কাজ টা ঠিক করেনি, তা তুমি তোমার বাবার কাছে
যাবে? বাবা! কথা টা শুনে বুকের ভেতর ধাক্কা লাগলো। আমি মাথা
নাড়িয়ে বললাম, যাবো। একটু পর মামা আম্মু কে ডাকলো। আম্মু আসলেই মামা বললো, ওকে
দিয়ে দেও বড় হয়ে গেছে বুজতে শিখেছে! আমি কোন কিছুই বুজতে পারলাম না কি বলছে!
আম্মুর দিকে তাকালাম দেখলাম আম্মু কান্না করছে আর মামা কে বলল, দিবো!
জীবনের কোন কিছু বুঝে ওঠার
আগেই অনেক কিছু বুঝে নিতে হলো। দেখে নিতে হলো জীবন কতটা বিচিত্র। সম্পর্ক কত রূপ!
এতদিন যাকে মামা ভাবতাম সে আসলে কে ছিলো বুঝে গেলাম। পারিবারিক সম্মতিতে বাবা মার
বিয়ে হয়, কিন্তু মা
কোনদিন বাবা কে মেনে নিতে পারেনি, কারন মা অন্য ছেলেকে
ভালোবাসত! মা পারিবারিক কারনেই রাজী হয়ে বাবাকে বিয়ে করে। বাবা কে মা সব জানায়,
এবং আরো বলে মা কোনদিন এই সংসারে থাকবে না। সে তার আগের মানুষের কাছে চলে যাবে এবং সেও ততো
দিন তার জন্য অপেক্ষা করবে। বাবা সব কিছু শুনে মেনে নিল। কিন্তু সমস্যা হয়েছিল
দাদা-দাদী, পরিবারের কেউ এই সব কথা জানতো না। এভাবে তাদের
মাঝে দু’বছর পার হয়ে যায়। দাদা-দাদী মফঃস্বল এ থাকে মা ও তাদের সাথে থাকতো শুধু
বাবা ঢাকায় থাকতো। কারন উনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন, বাবা ঢাকাই থাকতেন খুব একটা আসতেন না। এভাবে চলতে থাকে একদিন দাদা-দাদী বাবা
আর মা কে কাছে ডেকে আবদার করে বসে যাতে মৃত্যুর আগে নাতী-নাতনীর মুখ দেখে যেতে
পারে। দাদা-দাদী আর সামাজিকতার কারনেই এক সময় আমার আগমন হয়! একটা সময় দাদা-দাদী ও
চলে গেলেন। বাবা, মাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। মা
কে আলাদা বাসা ঠিক করে দেয়। বাবা মা কে ডিভোর্স লেটারে সই করতে বলে, মা সই করেন! কিন্তু তার আগে মা-বাবা কে আরেক টি শর্তে বন্দী করে, তাহল আমাকে
মা তার সাথে রাখবে। কোন দিন বাবার কাছে যেতে চাইলে পাঠিয়ে দিবে এবং সব খরচ বাবাকেই
বহন করতে হবে। বাবা প্রথমে শর্ত মেনে নিতে রাজী হননি। কিন্তু আমাকে দেখবে কে তা
ভেবে রাজি হয়। সব শর্ত মেনে নিলো! তারপর.......
সম্পূর্ণ ঘটনাটা বাবা কাছে
শুনেছি। শোনার পর কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিলো না। নিজের গায়ে জেনো আগুন জ্বালিয়ে দেই।
বাবাকে বিশ্বাস করতে পারছিলা না, তাকে মিথ্যুক বলে চিৎকার করতে লাগলাম। সাথে সাথে
বাবার মোবাইল দিয়ে মাকে ফোন করি, বাবা যা বলেছে তা সত্যি কিনা যাচাই করার জন্যে! ফোন করার সাথে
সাথে ধরলো সেই মামাটি, মায়ের প্রতি কেন জানি একটা ঘৃণা চলে
আসলো। মা ফোন ধরতেই জানতে চাইলাম ঘটনা গুলো সত্যি কিনা, মা কান্না করছেন। বুঝতে
পারলাম সব কিছু। মা ওপ্রান্তে বলতে লাগলো, আমার জীবনেও এমন মানুষ দেখিনি। তুই যার
কাছে আছিস সে অনেক মহৎ ব্যক্তি। তোকে দেখে শুনে রাখবে, কোন
দিন তাকে কষ্ট দিস না! আমাকে ভুলে যাইস। মায়ের কথা শুনেই মনেহল মা কে গালি দেই,
তার প্রতি প্রবল ঘৃণা কাজ করে। পৃথিবীতে পায়ের নিচের মাটি গুলোকে শূন্য লাগছে,
রাগ-ঘৃণা সব কিছু পিষে ফেলছে। সাথে সাথে ফোন টা রেখে দেই। আমার বাবা মাথা নিচু করে
বসে আছে। বাবার পাশে যেতেই বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরলো! আমি আর বাবা চিৎকার করে কান্না
করছি! বাবা কে বললাম আমার কি অপরাধ ছিল, কেন তোমরা আমাকে এই
পৃথিবীতে আনলে? বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল; সব অপরাধ আমার, আমাদের
ভালোবাসায়! তোমার কোন অপরাধ নেই।
বাহিরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে আমি
আর বাবা কেঁদেই চলছি বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে যাচ্ছে শব্দকান্না! একটা সময় সবকিছু কেমন
জেনো বদলে যায়। আমি চুপ হয়ে যাই। মাকে সেই দিন থেকেই ঘৃণা করি! একদিন বাবার কাছ
থেকে মার মোবাইল নম্বর নিয়ে ফোন করি। শুধু একটা কথা আবার জানার জন্য, আমার অপরাধ
কোথায়? আমার বাবার
অপরাধ কি ছিল? ভালোবাসাই কি সব কিছু? অনেক
ঘৃণা জেগে উঠলো। প্রশ্ন গুলো করার পরই আমি আর কথা বলতে পারিনি! কিছুদিন মানসিক ও
শারীরিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি! আমার বাবাটা কে দেখলে আমার অনেক মায়া হয়। কেমন করে
একটা মানুষ এমন কষ্ট বুকে জমিয়ে বেঁচে আছে? এতদিন একা কি করে ছিল। মাটা কেন এমন
হলো। নিজের ভালোবাসা আর স্বার্থের জন্য দু’টা মানুষ কে কেন এমন কষ্ট দিল !
পৃথিবীতে সব ঘটনা এবং প্রশ্নের কোন উত্তর, কারও হয়তো জানা নেই।
বাবা তার ক্লাস আর ছাত্র-ছাত্রীদের
নিয়ে সব সময় ব্যস্ত থাকেন। অবসরটা তে আমি আর বাবা মিলে গেমস খেলি। বাবাকে একদিন
দুষ্টামী করে বলেছিলাম একটা বিয়ে করতে, বাবা হেসে বলল এত দিন বিয়ে করিনি এখন করে
কি হবে। কথাটা শুনে মনের মধ্যে কেমন জানি বেজে উঠলো! সকালে ঘুম থেকে উঠে বাপ-বেটা
বের হয়ে যাই, বাবা তার কাজে আর আমি আমার ক্লাসে। আমার জন্য
আমার বাবা অনেক কষ্ট করেছে, এতগুলো বছর একটা মানুষ একা
কাটিয়েছে কি করে ভাবতেই কেমন লাগত। বাবা আমার জীবনের সবকিছু। তবে মাঝে মাঝে নিজেকে
অনেক ছোট মনে হয়, সবার মা আছে। কিন্তু আমার, আমার যে থেকেও নেই। অনেক জায়গায় গেলে মানুষ জানতে চায়; তোমার বাবা কি করেন?
মা কি করেন? বাবা কি করে বললেও মা কি করে বলতে পারি না। মা
যেনো এখন আমার কাছে জীবিত থেকেও মৃত কেউ! এখনো আমি স্রষ্টার কাছে জানতে চাই আমার
বাবার অপরাধ কি ছিলো, আমার কি অপরাধ ছিলো, আমাদের জীবন টা
কেন এমন হলো? সময়ের সাথে সাথে মানুষ তার নিজের ভাগ্যটাকে
মেনে হয় মাথা নিচু করে, আমি নিজেও যেমন নিয়েছি। কিছু করার নেই আসলে, যুদ্ধটা তো
একারই। বাবা কে নিয়ে সুখে আছি, আমি আমার বাবা কে অনেক অনেক
বেশি ভালোবাসি!
বিঃদ্রঃ- এই ঘটনাটি খুব
চেনা-অচেনা একটা মানুষের জীবনের। কার জীবনে কি ঘটে যাচ্ছে কেউ জানি না। মানুষের জীবন খুব বিচিত্র! অনেকেই
আছে, যারা নিজের
জন্য ভাবে কিন্তু একবারও ভাবে না তার সন্তানের কথা। আমাদের দেশে আজকাল যে প্রচলনটা
খুব বেশি শোনা, এর ডিভোর্স হয়ে গেছে, ও
অন্য ছেলের সাথে পালিয়ে গেছে সন্তান রেখে, তার স্বামী আরেকটা
বিয়ে করেছে, কোন মেয়ে তার নিজের ক্যারিয়ারের জন্য স্বামী
সন্তান রেখে চলে গেছে, কি সব আজব ঘটনা! সবাই সবার ভালোবাসা
আর ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত কিন্তু কেউ কেন যে তার সন্তানদের নিয়ে ভাবেনা। অথচ তার
সন্তান যখন বড় হবে জানতে চাইবে বাবা কে মা কে? তখন কোন জবাব
দিতে পারবে কি কেউ? বাবা-মার ভুল সিদ্ধান্ত গুলো সন্তানের
উপর কত টুকু প্রভাব পড়বে কেউ কি চিন্তা করেছে?? বা করবে??
না কি সন্তানকে সারাজীবন একটি প্রশ্ন বয়ে বেড়াতে হবে? 'আমার অপরাধ কোথায়?'!
অনেক বড় হয়ে গেছিস তুই, জটিল সব চিন্তা করতে শিখে যাচ্ছিস :)
উত্তরমুছুনকিন্তু একটা কথা, বানান ভুল করিস কেন এত! :@
ভালো থাকিস।
আপুর লেখাগুলো বেশ জীবনমুখী... আমার এই পাথরের চোখেও জল আনলো।
উত্তরমুছুন